নিজে মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সেবা করে চলেছেন দরিদ্র্য আছর আলী। চা বিক্রেতা আছর আলী দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের বিনামূল্যে চা পান করিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও মুক্তিযুদ্ধের গৌরব-বেদনা আর আনন্দ-বিষাদকে প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করেছেন তিনি। পরিবারে সবার সঙ্গে বাড়ির আঙিনায় গর্তে লুকিয়ে থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর লোমহর্ষক পৈশাচিক কার্যকলাপ। দেখেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অসাধারণ বীরত্ব আর আত্মত্যাগ। তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতেন, জাতির এ বীর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের জন্য কিছু করার। কিন্তু অস্বচ্ছলতার কারণে তার ইচ্ছাপূরণ হয়নি। তারপরও দমে যাননি। সামর্থ অনুযায়ী দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে এলাকায় বিনামূল্যে চা পান করানোর মধ্যদিয়ে তিনি সম্মান দেখিয়ে যাচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।

টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার বীরতারা ইউনিয়নের বাজিতপুর বাজারে দরিদ্র চা বিক্রেতা আছর আলী। দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের বিনামূল্যে চা পান করিয়ে যাচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ১১ বছর। বর্তমান বয়স ৫৮ বছর। বাজিতপুর গ্রামের মৃত ময়ান উদ্দিনের ছেলে আছর আলী। বাজিতপুর বাজারেই রয়েছে তার এ ‘মুক্তিসেবা টি স্টলটি’। গ্রামের মুক্তিযোদ্ধারা চা পান করে অনেক চেষ্টা করেও তাকে চায়ের বিল দিতে পারেন না।

আছর আলী জানান, স্বাধীনতার পর বাবার সঙ্গেই গৃহস্থালীর কাজ করতো সে। কয়েক বছর পর বাবার মৃত্যুতে সংসারের হাল তাকেই ধরতে হয়। শুরু করে দিনমজুরি। ৩৫ বছর আগে সামান্য পুঁজি নিয়ে বাড়ির সামনে বাজিতপুর বাজারে শুরু করেন এ চায়ের দোকান। আছর আলী বলেন, যারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন, তাদের সেবা করার সাধ্য আমার নেই। তাদের সামান্য দুইটা বিস্কুট, এ গ্লাস পানি আর এক কাপ চা পান করিয়ে আমি আত্মতৃপ্তি লাভ করি। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে সামান্য এ সেবা যেনো আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত করে যেতে পারি এবং আমার পরিবারের সবাই যেনো এ সেবার ধারাবাহিকতা বজায় রাখে- এটাই আমার আশা।

আছর আলী আরো বলেন, আমি বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ জানাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করায়। সাথে সাথে আরো দাবি জানাই- দেশের বিরুদ্ধে যারা চক্রান্ত ও যড়যন্ত্র করে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা ও মা-বোনদের ক্ষতি করেছে সেই সব আল-বদর ও রাজাকারদের যেনো দ্রুত বিচার হয়।

আছর আলীর স্ত্রী অজুফা বেগম (৪৫) জানান, স্থানীয় বেসরকারী সংস্থা ব্র্যাক ও সেবা থেকে ঋণ নিয়ে এ চায়ের দোকান ও ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছি। অনেক কষ্ট করে ঋণের কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে হয়। ঘরে বৃদ্ধ শাশুড়ি। সেও শয্যাসায়ী। তার ওষুধপত্র ও পথ্যাদি যোগাড় করতে হিমসিম খেতে হয়।

আছর আলীর ৩ সন্তান। দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে মঞ্জু (২২) এ বছর ধনবাড়ী কলেজ থেকে বিএসএস বিভাগ থেকে বিএ পরীক্ষা দিয়েছে। মেয়ে আশিকা (১৬) স্থানীয় বাজিতপুর স্কুল থেকে মানবিক বিভাগ নিয়ে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। ছোট ছেলে তানভির (১১) বাজিদপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। বাড়ির ভিটা ছাড়া সম্পদ বলতে আর কিছুই নেই। চায়ের দোকানটাই তার একমাত্র সম্বল। খুব কষ্টে দিনযাপন করছেন। তবুও তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এ সেবা করতে পেরে খুবই খুশি। আছর আলীকে চায়ের দোকানে সাহায্য করে তার ছোট ছেলে তানভির। মুক্তিযোদ্ধাদের এ সেবা করতে পেরে তানভিরও অনেক খুশি।

স্থানীয় এলাকাবাসীরা জানান, স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর বর্তমান সরকারের সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা অনেক স্বাবলম্বী হয়েছে। তারপরও আছর আলী তাদের সম্মান জানিয়ে বিনামূল্যে চা খাওয়ায়। এটা আমাদের গ্রামের জন্য গর্বের। তার এ কাজকে আমরা শ্রদ্ধা জানাই।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন মাষ্টার ও শাহজাহান আলী জানান, দরিদ্র আছর আলীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এ শ্রদ্ধা ও ত্যাগ সত্যিই প্রশংসনীয়। আমরা অনেক চেষ্টা করে কোন দিন এক কাপ চায়ের দামও তাকে কেউ দিতে পারিনি। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ছাড়াও বিভিন্ন জেলা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এখানে আসেন।

ধনবাড়ী সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আনোয়ার হোসেন কালু জানান, আছর আলীর এ মানবতার জন্য বাংলাদেশে অনেক জায়গা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা তাকে দেখার জন্য আসে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তার এ সম্মান নজিরবিহীন। অনেকে আমাদের সম্মান না করলেও আছর আলী আমাদের বিনামূল্যে চা-বিস্কুট খাওয়াচ্ছে। তার জন্য মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নেয়া হবে।